কাপুঁনি বা পারকিনসন্স রোগের কারন ও ফিজিওথেরাপি

পারকিনসন্স ডিজিজ স্নায়ুতন্ত্রের একটি ক্রমবর্ধমান ব্যাধি, যা শরীরের স্বাভাবিক নড়াচড়া করার ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এক হাতে সামান্য কাঁপুনি সৃষ্টির মধ্য দিয়ে এই ব্যাধির সূত্রপাত ঘটে। তবে কাঁপুনি পারকিনসন্স ডিজিজের প্রধান লক্ষণ হলেও এর ফলে শরীরে অনমনীয়তা দেখা দেয় ( অর্থাৎ শরীরের মাংশ পেশী শক্ত হয়ে যায় ) এবং শরীরের স্বাভাবিক নড়াচড়া ধীর হয়ে যায়।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে এ্যালঝেইমারসের পরেই পারকিনসন্স রোগ মস্তিষ্কের দ্বিতীয় ক্ষয়জনিত রোগ। এই রোগে স্নায়ুকোষগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে আগেই মারা যায় এবং প্রতিস্থাপন হয় না।নিউরো-ডিজেনারেটিভ রোগ হল মানব মস্তিষ্ক সংশ্লিষ্ট নিউরনের বিভিন্ন সমস্যা। নিউরন হল স্নায়ুতন্ত্রের মূল ভিত্তি, যাতে আরও আছে মস্তিষ্ক ও সুষুম্না। নিউরন কখনো নিজে থেকে জন্ম নেয় না, তাই এগুলো যখন ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা একেবারে ক্ষয়ে যায়, তা আর প্রতিস্থাপিত করা যায় না।নিউরোডিজেনারেটিভ রোগ সাধারণত অপ্রতিকার্য হয় আর শরীর দুর্বল করে তুলে, যার কারণে শরীরের অধঃপতন হয় এবং/বা স্নায়ুর মৃত্যু হয়। এর কারণে শারীরিক চলাফেরাতে ব্যাঘাত (অ্যাটাক্সিয়া) বা মানসিক ব্যাঘাত (ডিমেনশিয়া) ঘটে থাকে। পারকিনসন্স ডিজিজের প্রাথমিক পর্যায়গুলিতে আক্রান্ত ব্যক্তির মুখমণ্ডলে অভিব্যক্তি কম প্রকাশ পায় বা একেবারেই প্রকাশ পায় না। হাঁটার সময় এই ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তির হাত ঠিকমতো দোলে না। এছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির কথাও বেধে যেতে পারে। পারকিনসন্স ডিজিজের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকলে লক্ষণগুলিও আরও তীব্র হতে থাকে। সাধারণত মধ্য বয়স কিংবা তারপর থেকেই এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। ৬০ বছর কিংবা তার চেয়ে বেশি বয়স্কদের ক্ষেত্রে এর হার দুই শতাংশ। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার বয়স্ক মানুষ এই রোগের শিকার। চিকিৎসক জেমস পারকিনসন্সের নামানুসারে এই রোগের নামকরণ করা হয়। তিনি ১৮১৭ সালে তাঁর গ্রন্থ 'দ্য শেকিং পালসি'তে এই রোগ নিয়ে গবেষণামূলক আলোচনা করেন। গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার বিজয়ী অভিনেতা বব হাস্কিন এবং বিখ্যাত মুষ্ঠিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীসহ অনেক লোকই পারকিনসন্স রোগে আক্রান্ত। পারকিনসন্স ডিজিজ ফাউন্ডেশন জানায়, এই রোগ মূলত জিনগত মিউটেশনের জন্য দায়ী। বংশে এই রোগ কারো থাকলে ভবিষ্যৎ বংশধরদের এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা ৪ থেকে ৯ শতাংশ। মূলত মস্তিষ্কের যে কোষগুলো ডোপামিন নামের এক ধরনের রসায়ন তৈরি করে, অর্থাৎ যেগুলো শরীরের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ রক্ষার কাজে সব সময় নিয়োজিত, সেগুলো তৈরি করতে না পারাটাই পারকিনসন্স রোগের শুরু। ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলোর কারণে হাত-পায়ের কাঁপুনি এমনকি হাঁটাচলার নিয়ন্ত্রণও থাকে না। কারসমূহঃ পারকিনসন্স ডিজিজের সঠিক কারণ এখনো অজানা, তবে এই রোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির প্রভাব রয়েছে বলে ধারণা করা হয় জিনঃ গবেষকরা সুনির্দিষ্ট কিছু জিনের পরিবর্তন চিহ্নিত করেছেন (genetic mutations) যেগুলি পারকিনসন্স ডিজিজের কারণ হতে পারে। তবে একই পরিবারের বেশ কিছু সংখ্যক ব্যক্তি পারকিনসন্স ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যতিত এই ধারণাটি অন্য কোনো ক্ষেত্রে তেমন প্রযোজ্য নয়। সুনির্দিষ্ট জিন ছাড়াও অন্যান্য জিনগত পরিবর্তনও পারকিনসন্স ডিজিজেজ ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। তবে এই ঝুঁকির মাত্রা খুব বেশি নয়। পরিবেশগত প্রভাবকঃ কিছু বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শ এবং পরিবেশগত বিষয় পারকিনসন্স ডিজিজের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। তবে এই ঝুঁকিও বেশি মাত্রার নয়। লিউই বডিজের ( Lewy bodies) উপস্থিতিঃ মস্তিষ্কের কোষের মধ্যে গুচ্ছাকারে থাকা উপাদান পারকিনসন্স ডিজিজের নির্দেশক। এগুলিকে লেউই বডিজ বলে। গবেষকরা ধারণা করেন যে, এগুলির সাথে পারকিনসন্স ডিজিজের কারণ সম্পর্কযুক্ত। লক্ষণঃ
এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে চিকিৎসকেরা নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি চিহ্নিত করে থাকেনঃ ১) অস্বাভাবিক অনৈচ্ছিক নড়াচড়া (Abnormal involuntary movements) ২) নড়াচড়া করতে সমস্যা হওয়া (Problems with movement) ৩) স্মৃতিশক্তির সমস্যা (Disturbance of Memory) ৪) মাথা ধরা (Dizziness) ৫) দুর্বলতা (Weakness) ৬) সারা শরীর শক্ত হয়ে যাওয়া (Stiffness all over) ৭) পায়ে দুর্বলতা অনুভব করা (Leg weakness) ৮) আংশিক দুর্বলতা (Focal weakness) ৯) মাংসেপশী শক্ত হয়ে যাওয়া (Muscle stiffness or tightness) ১০)কথা বলতে কষ্ট হওয়া (Difficulty speaking) ১১) পায়ের মাংসেপশী শক্ত হয়ে যাওয়া (Leg stiffness or tightness) ১২) ভয় এবং আতংক (Fears and phobias) ফিজিওথেরাপিঃ
এক্সারসাইজ বা ব্যায়ামের উপকারিতার শেষ নেই। বিশেষজ্ঞগণ ব্যায়ামের উপকারিতা নিয়ে একের পর এক নতুন নতুন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এবার বিশেষজ্ঞগণ স্নায়ুতন্ত্রের রোগ পারকিনসন্স রোগের উপসর্গ লাঘবে ব্যায়াম অত্যন্ত উপকারী বলে গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, এক্সারসাইজ থেরাপিতে পারকিনসন্স রোগের উপসর্গ লাঘবে উল্লেখযোগ্য রকম ভূমিকা রাখতে পারে। শুধু তাই নয়, ব্যায়ামের অন্যান্য উপকারিতা কম নয়। সাধারণত পারিকনসন্সের উপসর্গ যেমন: হাত কাঁপা, হাতের আঙ্গুল শক্ত হয়ে যাওয়া রোধে এক ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়, যার নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। আর ব্যায়ামের মাধ্যমে পারকিনসন্সের উপসর্গ লাঘবের ক্ষেত্রে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই এবং উপকারিতা ওষুধের মতই। টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ু রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সুজান ফক্স এই তথ্য দিয়েছেন। তবে ড: ফক্সের মতে, প্রাথমিক অবস্থায় পারকিনসন্স রোগ শনাক্ত করা গেলে এক্সারসাইজ থেরাপি সবচেয়ে বেশি ফল এনে দেয়। ফিজিওথেরাপির উদ্দেশ্যঃ • স্বাধীন কার্যক্ষমতা সংরক্ষন করে ও এর উন্নতি ঘটিয়ে জীবন মাত্রার মান উন্নয়ন করা • থেরাপিউটিক ব্যায়াম এর মাধ্যমে নড়াচড়ায় সক্ষম রাখা • নড়াচড়া ও শারীরিক অবস্থা সঠিক রাখা ও উন্নত করা • মাংশপেশীর ক্ষমতা বৃদ্ধি করা • অস্থি-সন্ধি স্বাভাবিক রাখা ও বিকলংগতা রোধ করা • শ্বাস-প্রস্বাসের জন্য ফুসফুসের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা • হৃদপিন্ডের ক্ষমতা ধরে রাখার পাশাপাশি রক্ত-সঞ্চাচলন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখা । • ঔষদের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করা । পারকিনসন্স সহ বিভিন্ন ব্যথা, স্নায়ুজনিত যেকোন সমস্যায় বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আপনার সময় ও অর্থ খরচের পরিমাণ কমে যাবে।

রাসেল আহম্মেদ।
ব্যাচেলর অব ফিজিওথেরাপি (জিবি-৩১)
Previous Post Next Post