প্লানটার ফ্যাসিয়াটিস বা পায়ের পাতায় ব্যথাঃ নিজেই চিকিৎসা করুন!!

আমাদের পায়ের তলায় আমরা শক্ত যে আবরন বা চামড়া দেখতে পাই, তার ঠিক ভিতরেই একগুচ্ছ টিস্যু থাকে, যাদেরকে একসাথে বলা হয় প্লানটার ফ্যাসিয়া। এই ফ্যাসিয়া আমাদের পায়ের গোড়ালি থেকে আঙ্গুল পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি পায়ের হাড় ও চামড়ার মাঝখানে থাকে যার ফলে আমরা আরাম করে হাটতে পারি। জুতার নিচের দিকে যদি নরম অংশটুকু না থাকতো তাহলে সেই জুতা পড়ে হাঁটতে যেমন কষ্ট হতো। প্লানটার ফ্যাসিয়া না থাকলেও আমাদের হাঁটতে তারচেয়ে বেশি কষ্ট হতো। যদি কোন কারনে ফ্যাসিয়া আঘাতপ্রাপ্ত হয়, তখনি পায়ের তলায় বিশেষ করে গোড়ালির অংশে আমরা ব্যথা অনুভব করি। হাঁটতে পারিনা, কাজ করতে পারিনা। যার কারনে আমাদের দৈনন্দিন কাজে অনেক সমস্যা দেখা দেয়। আর এই রোগটিকে বলা হয় প্লানটার ফ্যাসিয়াটিস।
পায়ের তলায় অবস্থিত চামড়ার ভিতরের ফ্যাসিয়া (সাদা)
যেসব কারনে প্লানটার ফ্যাসিয়াটিস বা পায়ের তলায় ব্যথা হয়ঃ (রিস্ক ফ্যাক্টর সহ)
  • কোন কারনে দীর্ঘ সময় যাবত পায়ের তলায় অস্বাভাবিক ভাবে চাপ পড়লে।
  • খুব বেশি হাঁটাহাঁটি করলে বা দৌড়ালে। (এতে ফ্যাসিয়ার কিছু টিস্যু ছিড়ে যায়, যার ফলে ব্যথা অনুভব হয়)
  • অতিরিক্ত শারিরিক ওজন হলে অর্থাৎ বেশি মোটা হলে। (এতে ফ্যাসিয়ার উপর অনেক ভারি চাপ পড়ে এবং ইনজুরি হয়)
  • দীর্ঘ সময় যাবত দাড়িয়ে কাজ করলে।
  • পায়ের পাতা সমান হলে অর্থাৎ ফ্লাট ফুট থাকলে।
  • দীর্ঘ সময় ধরে উচুঁ জুতা পরিধান করলে।
  • পায়ের পাতায় টান লাগে বা চাপ পড়ে এরকম ব্যায়াম নিয়ম না জেনে বেশি সময় যাবত করলে৷
  • হাঁটুর নিচে পিছনের দিকের মাংস টাইট থাকার কারনে এংকেল জয়েন্ট ঠিকভাবে কাজ করতে পারেনা, যার ফলেও ফ্যাসিয়াতে সমস্যা হতে পারে।
  • গর্ভবতী মায়েদেরও এ রোগ হতে পারে। বিশেষ করে শেষের দিকে। কারন তখন শরীর কিছুটা ভারি হয়, লিগামেন্ট গুলো রিলাক্স থাকে৷ যার ফলশ্রুতিতে ফ্যাসিয়াতে চাপ পড়ে এবং ব্যথা হয়।
সাধারন পা ও সমতল আকারের পা বা ফ্লাট ফুট
কারা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়?
  • শিক্ষক
  • যাদের শারিরীক ওজন তুলনামূলক বেশি।
  • যারা নৃত্য করে।
  • কারখানার শ্রমিক (যারা শক্ত তলের উপর দীর্ঘক্ষন দাড়িয়ে কাজ করে)
  • রানার্স, জাম্পার্স বা যারা অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে গন্তব্যে যায়।
  • যাদের বয়স ৪০-৬০ বছর।
উপসর্গ (এ রোগ হলে যা যা সমস্যা দেখা দেয়)
  • পায়ের নিচে বিশেষ করে গোড়ালির কাছাকাছি খুব ব্যথা হবে (ছুড়ি দিয়ে আঘাত করলে যেমন ব্যথা হয় ঠিক তেমন ব্যথা হবে)
  • ব্যায়াম করার পরে ব্যথা হবে। যখন ব্যায়ম করবেন তখন তেমন একটা ব্যথা হবেনা।
  • সকালে ঘুম থেকে উঠার পর বা অনেক্ষন বিশ্রাম নেওয়ার পর বা অনেকক্ষন দাড়িয়ে বা বসে থাকার পর আপনি যখন হাঁটা শুরু করবেন তখন প্রথম কয়েক স্টেপ বেশি কষ্ট হবে, ব্যথা হবে৷ কিছুক্ষন হাঁটার পর ব্যথাটা কমে আসবে।
কিভাবে বুঝবেন আপনি এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন কিনা?
উপরের লক্ষণ বা উপসর্গ গুলো আপনার মাঝে আছে কিনা সেটা বিবেচনা করেও বুঝতে পারবেন। তাছাড়া খুবই সাধারন একটি পরীক্ষার মাধ্যমে আপনি নিজেই পরীক্ষা করে দেখতে পারবেন যে আপনার এই রোগটি আছে কিনা৷ পরীক্ষাটির নাম উইন্ডলাস পরীক্ষা৷
আপনার পার্শ্ববর্তী কাউকে অনুরোধ করুন চিত্রের মত করে পরীক্ষাটি করে দেওয়ার জন্য। যদি বুড়ো আঙ্গুল চিত্রের মত করে বাঁকা করে অন্য হাতের আঙ্গুল দিয়ে ফ্যাসিয়াতে চাপ দেওয়ার পর ব্যথা হয়, তাহলে বুঝে নিবেন আপনার প্লানটার ফ্যাসিয়াটিস আছে।  
আপনি এ রোগের কোন ধাপে আছেন?
★যদি পায়ে কোন ব্যথা না থাকে - সুস্থ্য - ০
★ ব্যায়াম করার পরে ব্যথা হলে - ১
★ব্যায়ামের আগেও ব্যথা পরেও ব্যথা -২
★ব্যায়ামের আগে, পরে ও ব্যায়াম করার সময়েও ব্যথা- ৩
★সবসময় ই ব্যথা, এমনকি বিশ্রামের সময় ও ব্যথা-৪
চিকিৎসা পদ্ধতিঃ
আমাদের ধাপ গুলো অনুসরন করে সঠিকভাবে এবংনিয়ম মাফিক পালন করলে আপনি খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ।
১) আপনাকে প্রথম কয়েকদিন (২-৩ দিন) বিশ্রামে থাকতে হবে, পাশাপাশি পায়ের পাতায় ১৫-২০ মিনিট সময় ধরে বরফ লাগাতে হবে। রাতে ঘুমানোর সময় নাইট স্প্লিন্ট বা প্লানটার ফ্যাসিয়া ব্রেস পড়ে ঘুমাতে পারেন। এতে ব্যথা কিছুটা কমবে৷
চিত্রের মত করে বরফভর্তি বোতল তোয়ালের উপর রেখে পায়ের তলায় ম্যাসাজ করুন।
২) গোলাকার বল দিয়ে চিত্র এর মত করে ম্যাসাজ করতে পারেন।

৩) স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ করতে হবেঃ প্লানটার ফ্যাসিয়া, কাফ মাসল(হাটুর নিচের পিছনের দিকের মাংসপেশি), এন্টেরিয়র টিবিয়ালিস(হাটুর নিচের সামনের দিকের মাংসপেশি) এই তিনটি মাংসপেশির স্ট্রেচিং করতে হবে। স্ট্রেচিং করলে মাংসপেশিতে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়, মাংসপেশিতন্তু নমনীয় ও প্রশস্ত হয়। নিচের চিত্রের মত করে খুব সহজে বাসায় আপনি নিজেই স্ট্রেচিং করতে পারবেন৷ স্ট্রেচিং করার আগে অবশ্যই ওয়ার্ম আপ(একটু হাঁটাহাঁটি বা সাধারন রকমের কিছু ব্যায়াম করে নিবেন, যাতে শরীর কিছুটা গরম হয়) করে নিবেন। প্রতিটি স্ট্রেচিং ৫-১০ বার করে করবেন। স্ট্রেচ বা টান অবস্থায় ১৫-২০ সেকেন্ড ধরে রাখবেন। মাঝখানে বিরতি দিয়ে করবেন। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করবেন।
প্লানটার ফ্যাসিয়া স্ট্রেচিং টেকনিক
কাফ মাসল স্ট্রেচিং টেকনিক-১
কাফ মাসল স্ট্রেচিং টেকনিক-২

এন্টেরিয়র টিবিয়ালিস মাসল স্ট্রেচিং টেকনিক-১
এন্টেরিয়র টিবিয়ালিস মাসল স্ট্রেচিং টেকনিক-২ 
৪) স্ট্রেংদেনিং এক্সারসাইজ বা মাসলের শক্তি বৃদ্ধিঃ যখন আপনার মাংসপেশির শক্তি বৃদ্ধি পাবে তখন আপনি অনেকটাই সুস্থ্য হয়ে যাবেন। স্ট্রেচিং এর পর ঐ একই মাংসপেশি গুলোর স্ট্রেংদেনিং করতে হবে৷ নিচের চিত্রের মত করে সহজেই করতে পারবেন।
প্লানটার ফ্যাসিয়া মাসলের স্ট্রেংদেনিং টেকনিক-১ (মেঝে থেকে ছোট বল বা পেন্সিল পায়ের আঙ্গুলের সাহায্যে তুলে অন্য জায়গায় জমা করবেন। এতে প্লানটার ফ্যাসিয়ার শক্তি বাড়বে।

প্লানটার ফ্যাসিয়া স্ট্রেংদেনিং টেকনিক-২ (পায়ের আঙ্গুল দিয়ে তোয়ালে ভাঁজ করবেন)
যা থেকে বিরত থাকবেনঃ
  • খুব বেশি দৌড়াদৌড়ি করবেন না যার কারনে কিনা পায়ের পাতায় প্রেশার পড়ে।
  • বেশিক্ষন দাড়িয়ে থাকবেন না।
  • উচু জুতা পড়া থেকে বিরত থাকবেন, পায়ের সাথে মানান সই জুতা পড়বেন।
  • শরীরের ওজন বেশি হয়ে থাকলে কমানোর চেষ্টা করবেন। 
এভাবে বাড়িতে সহজেই আপনি এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন। তবে ভাল চিকিৎসার জন্য অবশ্যই একজন কোয়ালিফাইড ফিজিওথেরাপিস্ট কে দেখিয়ে নিতে পারেন। কারন এ ব্যাপারে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট অনেক ভাল জানেন।
যতটুকু সম্ভব ঔষধ কম খাওয়ার চেষ্টা করবেন। সুস্থ্য থাকুন, ভালো থাকুন৷ আমাদের সাথেই থাকুন। 
Previous Post Next Post