ডেঙ্গু জ্বর কী ও কিভাবে ছড়ায়?
ডেঙ্গু জ্বরের উৎপত্তি ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা এবং এই ভাইরাস বাহিত হয় এডিস ইজিপ্টাই নামক মশার কামড়ের মাধ্যমে। ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোন ব্যক্তিকে কামড়ালে, সেই ব্যক্তি ৪ থেকে ৬ দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। এবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোন জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে, সেই মশাটিও ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে। ডেঙ্গু প্রধানত দুই ধরনের হয়ে থাকে, ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভার এবং ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার।
ডেঙ্গু জ্বর কখন ও কাদের বেশি হয়? মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, বিশেষ করে গরম এবং বর্ষার সময়টাতেই ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেশি থাকে। শীতকালে এই জ্বর হয় না বললেই চলে। শীতে লার্ভা অবস্থায় ডেঙ্গু মশা অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারে। বর্ষার শুরুতেই সেগুলো থেকে নতুন করে ডেঙ্গু ভাইরাস বাহিত মশা বিস্তার লাভ করে। সাধারণত শহর অঞ্চলে অভিজাত এলাকায়, বড় বড় দালান কোঠায় এই মশার প্রাদুর্ভাব বেশি, তাই ডেঙ্গু জ্বরও এই এলাকার বাসিন্দাদের বেশি হয়। বস্তিতে বা গ্রামে বসবাসরত লোকজনের ডেঙ্গু কম হয় বা একেবারেই হয় না বললেই চলে। দিন দিন বেড়েই চলেছে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা। ৬২ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ১৩৩৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন।সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ১৬-৩০ বছর বয়সীরা।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণসমূহ ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর ও সেই সঙ্গে সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়ে থাকে। জ্বর ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে থাকে। শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমড়, পিঠসহ অস্থি সন্ধি এবং মাংসপেশীতে তীব্র ব্যথা হয়। এছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পিছনে ব্যথা হয়। অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় যে মনে হয় বুঝি হাড় ভেঙ্গে যাচ্ছে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম ‘ব্রেক বোন ফিভার’। জ্বর হওয়ার ৪ বা ৫ দিনের সময় সারা শরীরজুড়ে লালচে দানা দেখা যায়, যাকে বলা হয় স্কিন র্যাশ, অনেকটা এলার্জি বা ঘামাচির মতো। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব, এমনকি বমি হতে পারে। রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করে এবং রুচি কমে যায়। সাধারণত ৪ বা ৫ দিন জ্বর থাকার পর তা এমনিতেই চলে যায় এবং কোন কোন রোগীর ক্ষেত্রে এর ২ বা ৩ দিন পর আবার জ্বর আসে। একে “বাই ফেজিক ফিভার”বলে।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর এই অবস্থাটাই সবচেয়ে জটিল। এই জ্বরে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গের পাশাপাশি আরো যে সমস্যাগুলো হয়, তা হলো-
**শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়, যেমন চামড়ার নিচে, নাক ও মুখ দিয়ে, মাড়ি ও দাঁত হতে, কফের সঙ্গে, রক্তবমি, পায়খানার সাথে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা, চোখের মধ্যে এবং চোখের বাহিরে, মহিলাদের বেলায় অসময়ে ঋতুস্রাব অথবা রক্তক্ষরণ শুরু হলে অনেকদিন পর্যন্ত রক্ত পড়তে থাকা ইত্যাদি। এই রোগের বেলায় অনেক সময় বুকে পানি, পেটে পানি ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। অনেক সময় লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস, কিডনীতে আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর ইত্যাদি জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহ রূপ হল ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের সাথে সার্কুলেটরী ফেইলিউর হয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়। এর লক্ষণ হলো- – রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া। – নাড়ীর স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হয়। – শরীরের হাত পা ও অন্যান্য অংশ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। – প্রস্রাব কমে যায়। – হঠাৎ করে রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের ১০টি ঘরোয়া চিকিৎসা পদ্ধতি
একাধিক প্রকৃতিক উপাদানকে কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই ডেঙ্গু জ্বরকে কাবু করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সাধারণত যে যে উপাদানগুলোর প্রয়োজন পড়বে, সেগুলি হলো... ১. পানি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে শরীরে পানির মাত্রা কমতে শুরু করে। তাই এই সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি খাওয়া একান্ত প্রয়োজন। এমনটা করলে ডেঙ্গুর বেশ কিছু লক্ষণ নিমেষে কমে যায়, যেমন- মাথা যন্ত্রণা, পেশির ব্যথা বা ক্র্যাম্প, ডিহাইড্রেশন প্রভৃতি। প্রসঙ্গত, শরীরে পানির মাত্রা বাড়লে দেহে উপস্থিত টক্সিক উপাদানের মাত্রাও কমতে শুরু করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভাইরাল ইনফেকশনের প্রকোপ কমতে শুরু করে। ২. নিম পাতা ডেঙ্গুর মতো ভাইরাল জ্বরের প্রকোপ কমাতে নিম পাতার কোনো বিকল্প হয় না বললেই চলে। আসলে এই প্রকৃতিক উপাদানটিতে থাকা বেশ কিছু কার্যকরী উপাদান শরীরে প্লাটিলেট কাউন্ট বাড়ানোর পাশাপাশি শ্বেত রক্ত কণিকার মাত্রা বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এখানেই শেষ নয়, দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তুলে ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রভাবকে দ্রুত কমিয়ে ফেলতেও নিম পাতা সাহায্য করে থাকে। ৩. পেঁপে পাতা প্লাটিলেট কাউন্ট বাড়ানোর পাশাপাশি শরীরে ভিটামিন-সি' র মাত্রা বৃদ্ধিতে পেঁপে পাতা দারুণভাবে কাজে আসে। সেই সঙ্গে দেহে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের মাত্রা বাড়িয়ে তুলে ডেঙ্গু জ্বরের নানাবিধ লক্ষণ কমাতেও এই প্রকৃতিক উপাদানটি সাহায্য করে থাকে। প্রসঙ্গত, প্রতিদিন পেঁপে পাতার রস খাওয়াতে হবে রোগীকে। তবেই উপকার মিলবে।
৪. কমলা লেবুর রস, এতে উপস্থিত অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন সি ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ কমানোর পাশাপাশি ভাইরাসের প্রকোপ কমাতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। শুধু তাই নয়, কমলা লেবুর রস একদিকে যেমন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতি ঘটায়, তেমনি শরীরে উপস্থিত ক্ষতিকর টক্সিনকেও বের করে দেয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই রোগের প্রকোপ কমতে শুরু করে। প্রসঙ্গত, কমলা লেবুতে উপস্থিত ভিটামিন সি কোষদের ক্ষত সারাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ফলে সার্বিকভাবে শরীর চাঙা হয়ে উঠতে একেবারে সময়ই লাগে না।
ডেঙ্গু জ্বর কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়? বর্তমানে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেড়েছে। তবে এ জ্বরে আতঙ্কিত না হয়ে প্রতিরোধের বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি। কিছু কিছু বিষয় জানা থাকলে এ জ্বর প্রতিরোধ করা সম্ভব। আসুন জানি, ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্যঃ **সতর্ক হোন, আতঙ্কিত হবেন না। আতঙ্কিত হলে করণীয় কাজটি ভুল হয়ে যাবে। ডেঙ্গুর শারীরিক লক্ষণ নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। লক্ষণ মিলিয়ে আসলে জ্বর আসে না সব সময়। এই আউটব্রেকের মৌসুমে জ্বর এলেই, মানে জ্বরের প্রথম দিনেই ডাক্তারের কাছে যাবেন। সিবিসি(CBC) ও ডেঙ্গু এনএসওয়ান(NS1) পরীক্ষা করবেন। ডেঙ্গু এনএসওয়ান এক থেকে তিন দিনের ভেতর পজিটিভ থাকে। এর সেনসিটিভিটি ৬৬ থেকে ৭০ ভাগ। ৩০ ভাগ ডেঙ্গু হবার পরও নেগেটিভ দেখাতে পারে। তাই চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণকে গুরুত্ব দিন। প্লাটিলেট নিয়ে অযথা ভীত হবেন না। প্লাটিলেট কাউন্ট ডেঙ্গুর প্রাথমিক ধারণা করতে সহায়তা করে। এর বেশি কিছু নয়। প্লাটিলেট ভালো থাকা বা খারাপ থাকা দিয়ে রোগীর ভালো-মন্দ বা রোগের তীব্রতা নির্ধারণ করা যায় না। ডেঙ্গু শক সিনড্রম একদম ভিন্ন জিনিস। প্লাটিলেট কম-বেশির সঙ্গে এর তেমন সম্পর্ক নেই। জ্বর কমে যাওয়ার পরই মূলত ক্রিটিক্যাল ফেইজ শুরু হয়। তাই জ্বর কমলেই ভালো হয়ে গেল সব কিছু এটা মনে করবেন না।
ডেঙ্গু জ্বর কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়? ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের মূল মন্ত্রই হলো এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং এই মশা যেন কামড়াতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা। মনে রাখতে হবে, এডিস মশা অভিজাত এলাকায় বড় বড় সুন্দর সুন্দর দালান কোঠায় বাস করে। স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে এই মশা ডিম পাড়ে। ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানি এদের পছন্দ নয়। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানগুলোকে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং একই সাথে মশক নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বাড়ির আশপাশের ঝোপ-ঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। যেহেতু এডিস মশা মূলত এমন বস্তুর মধ্যে ডিম পাড়ে যেখানে স্বচ্ছ পানি জমে থাকে, তাই ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে। ব্যবহৃত জিনিস যেমন মুখ খোলা পানির ট্যাংক, ফুলের টব ইত্যাদিতে যেন পানি জমে না থাকে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। ঘরের বাথরুমে কোথাও জমানো পানি ৫ দিনের বেশি যেন না থাকে। একুরিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনারের নিচেও যেন পানি জমে না থাকে। এডিস মশা সাধারণত সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। তবে অন্য সময়ও কামড়াতে পারে। তাই দিনের বেলা শরীর ভালোভাবে কাপড়ে ঢেকে বের হতে হবে, প্রয়োজনে মসকুইটো রিপেলেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। ঘরের চারদিকে দরজা জানালায় নেট লাগাতে হবে। দিনে ঘুমালে মশারি টাঙিয়ে অথবা কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমাতে হবে। শিশুদের মধ্যে যারা স্কুলে যায়, তাদের হাফপ্যান্ট না পরিয়ে ফুল প্যান্ট বা পায়জামা পরিয়ে স্কুলে পাঠাতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই সব সময় মশারির মধ্যে রাখতে হবে, যাতে করে রোগীকে কোন মশা কামড়াতে না পারে। মশক নিধনের জন্য স্প্রে, কয়েল, ম্যাট ব্যবহারের সাথে সাথে মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য দিনে ও রাতে মশারী ব্যবহার করতে হবে। যেহেতু ডেঙ্গু জরের কোন ভ্যাক্সিন বের হয় নাই, কোন কার্যকরী ঔষধও আবিস্কৃত হয় নাই। ডেঙ্গু জ্বরের মশাটি আমাদের দেশে আগেও ছিল, এখনও আছে, মশা প্রজননের এবং বংশবৃদ্ধির পরিবেশও আছে। তাই ডেঙ্গু জ্বর ভবিষ্যতেও একেবারে নির্মূল করা যাবে কিনা নিশ্চিত নয়। সুতরাং একমাত্র সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর হাত থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব।
লুবনা আক্তার ৩৫ তম ব্যাচ(জিবি) ব্যচেলর অব ফিজিওথেরাপি
ডেঙ্গু জ্বর কখন ও কাদের বেশি হয়? মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, বিশেষ করে গরম এবং বর্ষার সময়টাতেই ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেশি থাকে। শীতকালে এই জ্বর হয় না বললেই চলে। শীতে লার্ভা অবস্থায় ডেঙ্গু মশা অনেক দিন বেঁচে থাকতে পারে। বর্ষার শুরুতেই সেগুলো থেকে নতুন করে ডেঙ্গু ভাইরাস বাহিত মশা বিস্তার লাভ করে। সাধারণত শহর অঞ্চলে অভিজাত এলাকায়, বড় বড় দালান কোঠায় এই মশার প্রাদুর্ভাব বেশি, তাই ডেঙ্গু জ্বরও এই এলাকার বাসিন্দাদের বেশি হয়। বস্তিতে বা গ্রামে বসবাসরত লোকজনের ডেঙ্গু কম হয় বা একেবারেই হয় না বললেই চলে। দিন দিন বেড়েই চলেছে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা। ৬২ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ১৩৩৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন।সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ১৬-৩০ বছর বয়সীরা।
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণসমূহ ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর ও সেই সঙ্গে সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়ে থাকে। জ্বর ১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়ে থাকে। শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমড়, পিঠসহ অস্থি সন্ধি এবং মাংসপেশীতে তীব্র ব্যথা হয়। এছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পিছনে ব্যথা হয়। অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় যে মনে হয় বুঝি হাড় ভেঙ্গে যাচ্ছে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম ‘ব্রেক বোন ফিভার’। জ্বর হওয়ার ৪ বা ৫ দিনের সময় সারা শরীরজুড়ে লালচে দানা দেখা যায়, যাকে বলা হয় স্কিন র্যাশ, অনেকটা এলার্জি বা ঘামাচির মতো। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব, এমনকি বমি হতে পারে। রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করে এবং রুচি কমে যায়। সাধারণত ৪ বা ৫ দিন জ্বর থাকার পর তা এমনিতেই চলে যায় এবং কোন কোন রোগীর ক্ষেত্রে এর ২ বা ৩ দিন পর আবার জ্বর আসে। একে “বাই ফেজিক ফিভার”বলে।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর এই অবস্থাটাই সবচেয়ে জটিল। এই জ্বরে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গের পাশাপাশি আরো যে সমস্যাগুলো হয়, তা হলো-
**শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়, যেমন চামড়ার নিচে, নাক ও মুখ দিয়ে, মাড়ি ও দাঁত হতে, কফের সঙ্গে, রক্তবমি, পায়খানার সাথে তাজা রক্ত বা কালো পায়খানা, চোখের মধ্যে এবং চোখের বাহিরে, মহিলাদের বেলায় অসময়ে ঋতুস্রাব অথবা রক্তক্ষরণ শুরু হলে অনেকদিন পর্যন্ত রক্ত পড়তে থাকা ইত্যাদি। এই রোগের বেলায় অনেক সময় বুকে পানি, পেটে পানি ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। অনেক সময় লিভার আক্রান্ত হয়ে রোগীর জন্ডিস, কিডনীতে আক্রান্ত হয়ে রেনাল ফেইলিউর ইত্যাদি জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহ রূপ হল ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের সাথে সার্কুলেটরী ফেইলিউর হয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়। এর লক্ষণ হলো- – রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া। – নাড়ীর স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হয়। – শরীরের হাত পা ও অন্যান্য অংশ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। – প্রস্রাব কমে যায়। – হঠাৎ করে রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের ১০টি ঘরোয়া চিকিৎসা পদ্ধতি
একাধিক প্রকৃতিক উপাদানকে কাজে লাগিয়ে খুব সহজেই ডেঙ্গু জ্বরকে কাবু করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সাধারণত যে যে উপাদানগুলোর প্রয়োজন পড়বে, সেগুলি হলো... ১. পানি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে শরীরে পানির মাত্রা কমতে শুরু করে। তাই এই সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি খাওয়া একান্ত প্রয়োজন। এমনটা করলে ডেঙ্গুর বেশ কিছু লক্ষণ নিমেষে কমে যায়, যেমন- মাথা যন্ত্রণা, পেশির ব্যথা বা ক্র্যাম্প, ডিহাইড্রেশন প্রভৃতি। প্রসঙ্গত, শরীরে পানির মাত্রা বাড়লে দেহে উপস্থিত টক্সিক উপাদানের মাত্রাও কমতে শুরু করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভাইরাল ইনফেকশনের প্রকোপ কমতে শুরু করে। ২. নিম পাতা ডেঙ্গুর মতো ভাইরাল জ্বরের প্রকোপ কমাতে নিম পাতার কোনো বিকল্প হয় না বললেই চলে। আসলে এই প্রকৃতিক উপাদানটিতে থাকা বেশ কিছু কার্যকরী উপাদান শরীরে প্লাটিলেট কাউন্ট বাড়ানোর পাশাপাশি শ্বেত রক্ত কণিকার মাত্রা বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এখানেই শেষ নয়, দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তুলে ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রভাবকে দ্রুত কমিয়ে ফেলতেও নিম পাতা সাহায্য করে থাকে। ৩. পেঁপে পাতা প্লাটিলেট কাউন্ট বাড়ানোর পাশাপাশি শরীরে ভিটামিন-সি' র মাত্রা বৃদ্ধিতে পেঁপে পাতা দারুণভাবে কাজে আসে। সেই সঙ্গে দেহে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের মাত্রা বাড়িয়ে তুলে ডেঙ্গু জ্বরের নানাবিধ লক্ষণ কমাতেও এই প্রকৃতিক উপাদানটি সাহায্য করে থাকে। প্রসঙ্গত, প্রতিদিন পেঁপে পাতার রস খাওয়াতে হবে রোগীকে। তবেই উপকার মিলবে।
৪. কমলা লেবুর রস, এতে উপস্থিত অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং ভিটামিন সি ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ কমানোর পাশাপাশি ভাইরাসের প্রকোপ কমাতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। শুধু তাই নয়, কমলা লেবুর রস একদিকে যেমন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতি ঘটায়, তেমনি শরীরে উপস্থিত ক্ষতিকর টক্সিনকেও বের করে দেয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই রোগের প্রকোপ কমতে শুরু করে। প্রসঙ্গত, কমলা লেবুতে উপস্থিত ভিটামিন সি কোষদের ক্ষত সারাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ফলে সার্বিকভাবে শরীর চাঙা হয়ে উঠতে একেবারে সময়ই লাগে না।
৫. তুলসী পাতা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর মধ্যে দিয়ে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ কমাতে তুলসী পাতা দারুণভাবে কাজে আসে। সেই কারণেই বিশেষজ্ঞরা এমন রোগীদের নিয়মিত তুলসী পাতা খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
৬. মেথি, মেথি শরীরের উচ্চ তাপমাত্রা কমাতে সাহায্যে করে এবং শরীরের ব্যথা নিরাময়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। ফলে নিশ্চিন্ত ঘুম হয়, যা শরীরকে দ্রুত সুস্থ করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত উপযোগী।
৭. পুদিনা পাতা, পুদিনা পাতা চিবিয়ে খাওয়া গেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি পুদিনার তেল ব্যবহার করলে মশা আশপাশে ঘেঁষবে না।
৮. বার্লি পাতা, বার্লি পাতা চিবিয়ে খেলে তা শরীরের রক্ত উৎপাদনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শরীরে প্লাটিলেটের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
৯. শাকসবজি, অলিভ, সয়াবিন, ব্রকোলি, ফুলকপি, টমেটো প্রভৃতি সবজি শরীরের রক্তের প্রবাহকে স্বাভাবিক রাখে, ফলে রক্ত জমাট বাধতে পারে না। এর ফলে প্লাটিলেটের মাত্রাও সঠিক থাকে। তাই প্রচুর পরিমাণে সবজি খান।
১০. গোল্ডেন সিল, এটি লাল বা হলুদ বর্ণের এক ধরনের ফলবিশেষ যার মধ্যে থাকা অ্যান্টিভাইরাল উপাদান শরীরে উপস্থিত ডেঙ্গুর ভাইরাস দমনে সাহায্য করে। এটি জ্বর, বমি বমি ভাব, ঠাণ্ডা, মাথা ব্যথা ইত্যাদি কমাতে সাহায্য করে
ডেঙ্গু জ্বর কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়? বর্তমানে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেড়েছে। তবে এ জ্বরে আতঙ্কিত না হয়ে প্রতিরোধের বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি। কিছু কিছু বিষয় জানা থাকলে এ জ্বর প্রতিরোধ করা সম্ভব। আসুন জানি, ডেঙ্গু জ্বর সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্যঃ **সতর্ক হোন, আতঙ্কিত হবেন না। আতঙ্কিত হলে করণীয় কাজটি ভুল হয়ে যাবে। ডেঙ্গুর শারীরিক লক্ষণ নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। লক্ষণ মিলিয়ে আসলে জ্বর আসে না সব সময়। এই আউটব্রেকের মৌসুমে জ্বর এলেই, মানে জ্বরের প্রথম দিনেই ডাক্তারের কাছে যাবেন। সিবিসি(CBC) ও ডেঙ্গু এনএসওয়ান(NS1) পরীক্ষা করবেন। ডেঙ্গু এনএসওয়ান এক থেকে তিন দিনের ভেতর পজিটিভ থাকে। এর সেনসিটিভিটি ৬৬ থেকে ৭০ ভাগ। ৩০ ভাগ ডেঙ্গু হবার পরও নেগেটিভ দেখাতে পারে। তাই চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণকে গুরুত্ব দিন। প্লাটিলেট নিয়ে অযথা ভীত হবেন না। প্লাটিলেট কাউন্ট ডেঙ্গুর প্রাথমিক ধারণা করতে সহায়তা করে। এর বেশি কিছু নয়। প্লাটিলেট ভালো থাকা বা খারাপ থাকা দিয়ে রোগীর ভালো-মন্দ বা রোগের তীব্রতা নির্ধারণ করা যায় না। ডেঙ্গু শক সিনড্রম একদম ভিন্ন জিনিস। প্লাটিলেট কম-বেশির সঙ্গে এর তেমন সম্পর্ক নেই। জ্বর কমে যাওয়ার পরই মূলত ক্রিটিক্যাল ফেইজ শুরু হয়। তাই জ্বর কমলেই ভালো হয়ে গেল সব কিছু এটা মনে করবেন না।
ডেঙ্গু জ্বর কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়? ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের মূল মন্ত্রই হলো এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং এই মশা যেন কামড়াতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা। মনে রাখতে হবে, এডিস মশা অভিজাত এলাকায় বড় বড় সুন্দর সুন্দর দালান কোঠায় বাস করে। স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে এই মশা ডিম পাড়ে। ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানি এদের পছন্দ নয়। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানগুলোকে পরিষ্কার রাখতে হবে এবং একই সাথে মশক নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বাড়ির আশপাশের ঝোপ-ঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। যেহেতু এডিস মশা মূলত এমন বস্তুর মধ্যে ডিম পাড়ে যেখানে স্বচ্ছ পানি জমে থাকে, তাই ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে। ব্যবহৃত জিনিস যেমন মুখ খোলা পানির ট্যাংক, ফুলের টব ইত্যাদিতে যেন পানি জমে না থাকে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। ঘরের বাথরুমে কোথাও জমানো পানি ৫ দিনের বেশি যেন না থাকে। একুরিয়াম, ফ্রিজ বা এয়ার কন্ডিশনারের নিচেও যেন পানি জমে না থাকে। এডিস মশা সাধারণত সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। তবে অন্য সময়ও কামড়াতে পারে। তাই দিনের বেলা শরীর ভালোভাবে কাপড়ে ঢেকে বের হতে হবে, প্রয়োজনে মসকুইটো রিপেলেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। ঘরের চারদিকে দরজা জানালায় নেট লাগাতে হবে। দিনে ঘুমালে মশারি টাঙিয়ে অথবা কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমাতে হবে। শিশুদের মধ্যে যারা স্কুলে যায়, তাদের হাফপ্যান্ট না পরিয়ে ফুল প্যান্ট বা পায়জামা পরিয়ে স্কুলে পাঠাতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই সব সময় মশারির মধ্যে রাখতে হবে, যাতে করে রোগীকে কোন মশা কামড়াতে না পারে। মশক নিধনের জন্য স্প্রে, কয়েল, ম্যাট ব্যবহারের সাথে সাথে মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য দিনে ও রাতে মশারী ব্যবহার করতে হবে। যেহেতু ডেঙ্গু জরের কোন ভ্যাক্সিন বের হয় নাই, কোন কার্যকরী ঔষধও আবিস্কৃত হয় নাই। ডেঙ্গু জ্বরের মশাটি আমাদের দেশে আগেও ছিল, এখনও আছে, মশা প্রজননের এবং বংশবৃদ্ধির পরিবেশও আছে। তাই ডেঙ্গু জ্বর ভবিষ্যতেও একেবারে নির্মূল করা যাবে কিনা নিশ্চিত নয়। সুতরাং একমাত্র সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর হাত থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব।
লুবনা আক্তার ৩৫ তম ব্যাচ(জিবি) ব্যচেলর অব ফিজিওথেরাপি