নিউমোনিয়ার লক্ষণ, প্রতিকার ও চিকিৎসা


নিউমোনিয়া কি
নিউমোনিয়া হলো ফুসফুস শ্বাসতন্ত্রের রোগ।  ফুসফুসের এক ধরনের ইনফেকশনের নাম নিউমোনিয়া। এটি সাধারণত শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহের জন্য হয়ে থাকে, মেডিকেলের ভাষায় বলা হয় রেসপিরেটরি ট্রাক্ট ইনফেকশন (Respiratory tract Infection) এই প্রদাহ যখন জীবাণুঘটিত বা সংক্রমণজনিত হয়ে রোগ তৈরি হয় তখন এটাকে নিউমোনিয়া বলে। সংক্রমণ হতে পারে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক ইত্যাদি দিয়ে।
ফুসফুসে স্ট্রেপটোকক্কাস জাতীয় ব্যাকটেরিয়া কিংবা শ্বাসযন্ত্রের সিনসিশিয়াল ভাইরাস (আরএসভি) সংক্রমণ ঘটালে ফুসফুস ফুলে ওঠে, ভরে ওঠে পুঁজে বা তরল পদার্থে, যা অক্সিজেন গ্রহণ করে নিঃশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। তখন ফুসফুসে প্রদাহ হয়।

নিউমোনিয়ার লক্ষণ, প্রতিকার ও চিকিৎসা
কিভাবে ছড়ায় :
  •   নিউমোনিয়া অত্যন্ত সংক্রামক একটি রোগ। রোগের জীবাণু রোগাক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।
  • কোন সুস্থ শিশু আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে বা আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত কোন জিনিসের মাধ্যমে শিশুর শরীরে জীবাণু প্রবেশ করতে পারে।
  • রোগের জীবাণু সুস্থ মানুষের নাক মুখে থাকতে পারে যা শ্বাস গ্রহনের মাধ্যমে ফুসফুসে ছড়িয়ে রোগ হতে পারে।
  • আবার কিছু ক্ষেত্রে জীবাণু রক্তের সাহায্যেও ফুসফুসে সংক্রমিত হতে পারে।
কাদের হতে পারে :
যদিও নিউমোনিয়া যে কারোরই হতে পারে, তারপরেও কিছু ক্ষেত্রে রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। যেমন- ছোট্ট শিশু অথবা বয়স্ক ব্যক্তিরা  রোগে সহজেই আক্রান্ত হতে পারেন। আবার দীর্ঘদিন ধরে ভুগছে এমন কোন রোগ যেমন- ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ফুসফুসের কোন রোগ, এইডস ইত্যাদি রোগ থাকলে অথবা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে সহজেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন। ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি নিলে, স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ সেবন করলে অথবা যারা ধূমপান করেন কিংবা মাদকে আসক্ত তাদেরও হতে পারে।
শিশুরাই সহজে ঘনঘন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয় বেশি। কারণ নিউমোনিয়া একটি বায়ুবাহিত রোগ, সুতরাং নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত একটি শিশু যখন হাঁচি-কাশি দেয় বা নিঃশ্বাস ছাড়ে অথবা কথা বলে এর থেকে জীবাণু বের হয়ে বাতাসে মিশে যায়, আর ওই জীবাণুমিশ্রিত বাতাস যে শিশু শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করবে সে শিশুটিও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। ছাড়া সর্দি-কফের সরাসরি সংস্পর্শেও রোগটি হতে পারে। শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা কারণে বেশি হয় যে প্রথমত বড়দের তুলনায় শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিছুটা কম থাকে। শিশুরা একে অন্যের সঙ্গে মেলামেশা করে। যেমন- স্কুলে খেলাধুলার সময়। এভাবে একটি আক্রান্ত শিশু থেকে অন্য আরো শিশু আক্রান্ত হতে পারে। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় লক্ষ ২০ হাজার শিশু এবং বাচ্চা নিউমোনিয়ায় মারা যায়।

নিউমোনিয়ার লক্ষণ, প্রতিকার ও চিকিৎসা

নিউমোনিয়া রোগের কারণ :
  • ব্যাকটেরিয়া - নিউমোক্কাস,স্ট্যাফাইলোক্কাস ইত্যাদি।
  • আদ্যপ্রানী - এন্টামিবা হিস্টোলাইটিকা
  • ছত্রাক - মূলত যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের ছত্রাক দিয়ে হয়।
  • ভাইরাস।
  • কেমিকেল
  • হঠাৎ ঠান্ডায় উন্মুক্ত হওয়া
  • অপারেশনের পরর্বতী সময় ইত্যাদি।
নিউমোনিয়ার প্রকারভেদ :
নিউমোনিয়ার কারণের উপর ভিত্তি করে নিউমোনিয়াকে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়।
  1. কমিউনিটি  থেকে হওয়া নিউমোনিয়া
  2. হাসপাতাল থেকে হওয়া নিউমোনিয়া
  3. এ্যাসপিরেশন নিউমোনিয়া 
  4. সুযোগ সন্ধানী জীবাণু দিয়ে হওয়া নিউমোনিয়া
  5. অন্যান্য জীবাণু দ্বারা ঘটিত হওয়া নিউমোনিয়া 
লক্ষণ
·       নিউমোনিয়ার উপসর্গ গুলো বিভিন্ন হয়ে থাকে। এটা নির্ভর করে শারীরিক অবস্থা এবং কি ধরণের জীবাণুর সংক্রমণ হয়েছে তার উপর। নিউমোনিয়ার লক্ষণ সমূহ নিম্নরূপ:
  • জ্বর
  • কাশি
  • শ্বাসকষ্ট
  • কাপুনি
  •  ঘাম হওয়া
  • বুকে ব্যাথা যা শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে উঠা নামা করে
  • মাথা ব্যথা
  • মাংসপেশীতে ব্যাথা
  • ক্লান্তি অনুভব করা
কখন ডাক্তার দেখাবেন
  •  অস্বাভাবিক জ্বর, কাশি, শ্বাসকষ্ট, ঘাম, বুকে ব্যথা হওয়ার সাথে সাথে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
  • যারা ধূমপান করেন
  • যারা ফুসফুসে কোন আঘাত পেয়েছেন
  • যাদের কেমোথেরাপি (ক্যান্সারের চিকিৎসা) অথবা অন্য কোন ঔষধ খাওয়ার ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে
প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা
লক্ষণ বা উপসর্গ দেখে নিউমোনিয়া হয়েছে সন্দেহ হলে, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনে শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা, বুকের এক্সরে, রক্তের সি বি সি পরীক্ষা, কফ বা শ্লেষ্মা পরীক্ষা ইত্যাদি করাতে হতে পারে।

চিকিৎসা 
জ্বর কমানোর ওষুধ, খাবারের নির্দেশিকা, কাশির জন্য নেবুলাইজেশন এসব হলো নিউমোনিয়ার উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা। নিউমোনিয়ার নির্দিষ্ট বা স্পেসিফিক চিকিৎসা হলো রোগের কারণভিত্তিক চিকিৎসা। ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, ফাঙ্গাশ যে কারণে হোক তদানুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে। বড় বা ছোটদের শ্বাসকষ্ট এবং কাশির সঙ্গে রক্ত গেলে, উচ্চমাত্রার জ্বর সঙ্গে কাশি শ্বাসকষ্ট, বুক ব্যথা হলে সরাসরি হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়।

প্রতিরোধে করণীয় 
অসুস্থ্য হওয়ার পরে চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধে সতর্ক হওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই শিশুর নিউমোনিয়া প্রতিরোধে নিম্নলিখিত বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবেঃ
  • বাড়ির সকলকে অবশ্যই দিনে কয়েকবার সাবান দিয়ে ভালভাবে হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে।
  • গর্ভকালীন সময়ে মায়েদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তাদের যথাযথ যত্ন নিতে হবে যাতে অপরিণত বা স্বল্প ওজনের শিশুর জন্ম না হয়। কারন- অপরিণত বা স্বল্প ওজনের শিশুরা পরবর্তীতে খুব সহজেই নানান রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
  • কোন শিশু অপরিণত বয়সে জন্ম নিলে অথবা স্বল্প ওজনের শিশুদের ব্যপারে অতিরিক্ত সতর্কতা জরুরি।
  • শিশু যাতে অপুষ্টির শিকার না হয়, সেজন্য শিশুর জন্মের প্রথম মাস পর্যন্ত শিশুকে শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়াতে হবে এবং মাস পূর্ণ হলে শিশুকে মায়ের দুধের পাশাপাশি বাড়িতে তৈরি খাবার খাওয়াতে হবে।
  • বছর বয়স পর্যন্ত অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে হবে। কারণ- অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কম থাকে।
  • শিশুকে সময়মত সরকারিভাবে প্রদত্ত সবগুলো টিকা দিতে হবে।
  • কারও ঠাণ্ডা বা কাশি হলে অথবা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগী থেকে দূরে রাখতে হবে।
  • শিশুর থাকার জায়গা এবং বাড়ির পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
  •  বাড়িতে আলো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
  • শিশুকে সিগারেট বা চুলার ধোঁয়া থেকে দূরে রাখতে হবে।
আর বয়স্কদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নিম্নলিখিত ব্যপারে সতর্ক হতে হবেঃ
  • ভালোভাবে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে।
  • পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে হবে।
  • নিজের শরীরের যত্ন নিতে হবে এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম করতে হবে।
  • ধূমপান বা যেকোনো মাদক বর্জন করতে হবে।
  • অন্যের সামনে হাঁচি বা কাশি দেয়ার ক্ষেত্রে, অবশ্যই হাত বা রুমাল দিয়ে মুখ ঢাকতে হবে।
সবশেষে
নিউমোনিয়া অত্যন্ত সংক্রামক রোগ হওয়ায় এর প্রতিরোধে সচেতন থাকতে হবে। শিশুসহ পরিবারের সকলের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহন, দিনে কয়েকবার সাবান দিয়ে ভালভাবে হাত ধোয়া, ধূমপান বা যেকোনো মাদক বর্জন এবং নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশু বা ব্যক্তি থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে সহজেই নিউমোনিয়ার সংক্রমন থেকে নিরাপদে থাকা যায়।

দেবযানী শীল
২৮ তম ব্যাচ, (জিবি)
ব্যাচেলর অব ফিজিওথেরাপি

Previous Post Next Post